মোবাইল ব্যাংকিং খাতে সরকারিভাবে পরিচালিত অন্যতম প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’-এ ভয়াবহ অনিয়ম, লুটপাট ও অদৃশ্য দখলদারিত্বের এক বিস্তৃত চিত্র ধরা পড়েছে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে চলছে গোপন মিটিং, তথ্য গায়েব, ভুয়া বিল ভাউচারে অর্থ আত্মসাৎ ও বেআইনি নিয়োগ-বাণিজ্যের মহোৎসব। আর এই চক্রের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ডেপুটি সিইও মুয়ীজ নাসনিম ত্বকি, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ আতিক মোর্শেদ, এবং পেছন থেকে কলকাঠি নাড়া সাবেক সিইও তানভীর এ মিশুক।
আটক, ডিবি থেকে মুক্তি এবং বেপরোয়া ত্বকি
১৮ই মে রাতে, ডিবি পুলিশ নগদের ডেপুটি সিইও মুয়ীজ ত্বকিকে তার বেইলি রোডের বাসা থেকে আটক করে। তার হেফাজত থেকে জব্দ করা হয় কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন। তবে পরদিনই অজ্ঞাত কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, যা বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ও শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সরকারের একজন বিশেষ সহকারীর সরাসরি হস্তক্ষেপেই ত্বকির মুক্তি নিশ্চিত হয়।
মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই ত্বকির আচরণ হয়ে উঠেছে আরও বেপরোয়া। নগদের বিভিন্ন বিভাগে ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরির নির্দেশ দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
কে এই আতিক মোর্শেদ?
নগদে এখন আরেক আলোচিত নাম আতিক মোর্শেদ। তিনি সরকারি কোনো পদে নেই, নগদেরও কর্মকর্তা নন—তবুও নগদের ৬ তলায় নিয়মিত অফিস করছেন। তিনি সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ছিলেন। নগদের পরিচালনা বোর্ড বিলুপ্ত হওয়ার পর থেকেই মূলত তিনি প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন। এমনকি কখনো কখনো সিইও’র চেয়ারে বসতে দেখা গেছে তাঁকে।
সূত্র জানায়, নিজের স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা জুঁইকে ‘ম্যানেজার, কমপ্লায়েন্স’ পদে নিয়োগ দিয়ে আতিক নিজের অবস্থান আরও পাকাপোক্ত করেছেন। তার আত্মীয়দেরও বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
সিইও প্রহেলিকা: সাফায়েত আলম বাস্তবে ‘অনুপস্থিত’
নগদের বর্তমান সিইও মো. সাফায়েত আলম গত ১২ মে রাতে একটি ই-মেইলের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি এখনো দেশে ফেরেননি। অথচ ই-মেইল ও হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ১৯ জন শীর্ষ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছেন, অনেক বহিরাগতকে নিয়োগ দিয়েছেন।
সূত্র বলছে, সাফায়েত ও সাবেক সিইও তানভীর এ মিশুক বর্তমানে একই বিদেশি স্থানে অবস্থান করছেন। বাস্তবিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন তানভীর, আর সাফায়েত হচ্ছেন তার ‘ছায়া-সিইও’।
ডাটাবেজ ধ্বংস ও ভুয়া বিলের ছড়াছড়ি
১২ই মে মৌখিক আদেশে নগদের আইটি বিভাগকে ২৪ ঘণ্টা অফিস করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর সন্ধ্যার পর অফিস ফাঁকা করে দিয়ে পুরাতন ডাটাবেজ ও গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ধ্বংস করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। একইসঙ্গে পেছনের তারিখে ইভেন্ট দেখিয়ে তৈরি করা হয়েছে কোটি টাকার ভুয়া বিল ভাউচার।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, এভাবে অন্তত ৫০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে। ভুয়া বিলের কারণে ২০১৮ সালের একটি হত্যামামলার অভিযুক্ত আবু রায়হানকে পর্যন্ত ৯ মাসের বেতন বাবদ ৪৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে, যদিও তার চাকরি আগেই বাতিল হয়েছিল।
বরখাস্ত-নির্যাতন ও ‘নতুন নিয়মনীতি’
তানভীর অনুসারীদের পদোন্নতি দেওয়া হলেও, যারা বাংলাদেশ ব্যাংক বা কেপিএমজির অডিট টিমকে সহযোগিতা করেছিলেন, তাদেরকেই বরখাস্ত করা হয়েছে। যেন তারা ক্ষতিপূরণ না পান, সেজন্য ই-মেইলের মাধ্যমে হঠাৎ বদলে ফেলা হয়েছে নিয়োগ নীতিমালা।
বরখাস্ত হওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন:
ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর গোলাম মর্তুজা চৌধুরী
নির্বাহী পরিচালক সাইদুল খন্দকার
হেড অব কমপ্লায়েন্স খালেদ বিন কামাল
হেড অব এএমএল মো. শহিদুল ইসলাম
এন্ট্রি মানি লন্ডারিং বিভাগের আহমেদ আলী
বাংলাদেশ ব্যাংক: ‘শুনছি কিন্তু কিছু করতে পারছি না’
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসাইন খান মানবজমিনকে বলেন,
“আইনি সমস্যার কারণে আমরা নগদে প্রশাসকদের রাখতে পারিনি। আপিল করা হয়েছে, শুনানির অপেক্ষায় আছি। ভুয়া বিল, নিয়োগ, ডাটাবেজ মুছে ফেলা—সব শুনছি। কিন্তু আমরা ভেতরে যেতে পারছি না। মিডিয়ার সহায়তা দরকার।”
নগদের প্রতিক্রিয়া
ডেপুটি সিইও মুয়ীজ ত্বকি দাবি করেছেন,
“নগদের কোনো ডাটাবেজ ধ্বংস বা ভুয়া বিল হয়নি। আমি কাউকে নিয়োগ দিইনি। বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো রেগুলেটর হিসেবে রয়েছে।”
অন্যদিকে আতিক মোর্শেদ দাবি করেন,
“আমি নগদে চাকরি করি না। ডাক বিভাগের সমন্বয়ে কিছু বিষয় দেখছি মাত্র।”
উপসংহার: কে দেখছে ‘নগদ’-এর নগদ অর্থ?
নগদের সাম্প্রতিক কার্যক্রম দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। তানভীর এ মিশুকের ‘নিরাপদ প্রস্থান’-এর আড়ালে গোপন কর্তৃত্ব, ত্বকির মতো বিতর্কিত নিয়োগ এবং আতিক মোর্শেদের ছায়া-নেতৃত্ব ইঙ্গিত দিচ্ছে—নগদ চলছে এক অদৃশ্য সত্তার ইশারায়।
অর্থনীতির এই গুরুত্বপূর্ণ খাতের দায়ভার এখন যাদের কাঁধে, তাদের কার্যকলাপ নিয়ে যথাযথ তদন্ত ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে, এটি ভবিষ্যতে দেশের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে।