ভূমিকা
মৃত্যু মানেই ছিল একান্ত বিচ্ছেদ। একবার কেউ চলে গেলে তাকে আর পাওয়া যায় না—না দেখা, না শোনা, না কথা বলা। কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে এই ধারণাটা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। কেউ মারা যাওয়ার পরও তিনি থেকে যাচ্ছেন ফেসবুকে, ইনস্টাগ্রামে, ইউটিউবে—ছবি, ভিডিও, কমেন্ট, স্ট্যাটাসে। এমনকি কেউ কেউ মৃত্যুর আগে নিজের জন্য “ডিজিটাল উইল” রেখেও যাচ্ছেন, মৃত্যুর পর প্রকাশ করার মতো বার্তা তৈরি করে রেখে যাচ্ছেন। ফলে প্রশ্ন উঠছে: এই ডিজিটাল উপস্থিতি আমাদের শোককে কীভাবে প্রভাবিত করছে? আমরা কী নতুন এক ধরনের শোকের যুগে প্রবেশ করেছি—‘ডিজিটাল শোক’?
ডিজিটাল উপস্থিতির অবসান নেই
কোনো একজন প্রিয়জন মারা গেলে আমরা কাঁদি, তার ছবি দেখি, স্মৃতি চারণ করি—এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এখন একজন মানুষ মারা যাওয়ার পরও তার ডিজিটাল ছায়া ইন্টারনেটে রয়ে যায়।
ফেসবুক প্রোফাইল “মেমোরিয়াল” মোডে চলে যায়,
ইনস্টাগ্রামে তার শেষ পোস্টে মানুষ শোক প্রকাশ করে,
ইউটিউবে বা টিকটকে রয়ে যায় তার হাসিমুখের ভিডিও।
মৃত মানুষটির স্মৃতি যেমন রয়ে যায় পরিবারের মনে, তেমনি সে রয়ে যায় গুগলের সার্ভারে, ক্লাউডে, মেমোরি কার্ডে।
শোকের আবেগ ও ডিজিটাল জগত
“আমি এখনো রাতে ঘুমানোর আগে তার ফেসবুক প্রোফাইলটা দেখে নিই”—এ ধরনের কথা আজকাল আমরা হরহামেশাই শুনি। কেউ কেউ প্রতিদিন কথা বলেন মৃত বাবার মেসেঞ্জারে।
এই ডিজিটাল স্মৃতি মানুষের শোকের অভিজ্ঞতাকে অনেক দীর্ঘায়িত করে।
একদিকে এটা সান্ত্বনা দেয়—প্রিয় মানুষটার কিছু এখনো আছে,
অন্যদিকে এটা রূপ নিতে পারে অবসেশনে—যেখান থেকে বের হয়ে আসা কঠিন।
ডিজিটাল মৃত্যু ও উইল
বিশ্বে এখন “ডিজিটাল উইল” তৈরি করার চল শুরু হয়েছে।
মানুষ নিজের মৃত্যুর পর কী হবে তার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের, সেটার দায়িত্ব কার, এমনকি মৃত্যুর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাঠানোর মতো ইমেইল বা ভিডিও বার্তাও তৈরি করে রাখছে অনেকে।
ফেসবুক এখন “Legacy Contact” নির্ধারণ করতে দেয়—অর্থাৎ আপনি কার হাতে নিজের প্রোফাইলের নিয়ন্ত্রণ দেবেন মৃত্যুর পর।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে এখনো এ বিষয়ে খুব কম আলোচনা হয়েছে।
বেশিরভাগ মানুষ জানেই না, মৃত্যুর পর তাদের অনলাইন প্রোফাইল কীভাবে মুছে যাবে বা থাকবে।
গ্রামের মানুষ হয়তো প্রোফাইল ডিলিট করে ফেলে, কিন্তু শহুরে তরুণরা প্রায়ই “মৃত প্রিয়জনের ডিজিটাল স্মৃতিতে বেঁচে থাকা”কে সম্মান জানান।
এই বিষয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্নতা তৈরি করে—কেউ মনে করেন, মৃতের ছবি দেখা উচিত নয়; কেউ আবার বলেন, এটাই স্মৃতির ধারক।
উপসংহার
আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে মানুষের মৃত্যু মানেই সম্পূর্ণ বিলুপ্তি নয়। তার ভার্চুয়াল অস্তিত্ব রয়ে যায়, আর সেই অস্তিত্ব নিয়েই আমরা শোক করি, স্মরণ করি, কখনো আঁকড়ে থাকি। প্রযুক্তি আমাদের শোককে যেন আরও বেশি অনুভূতিপূর্ণ এবং একইসঙ্গে জটিল করে তুলেছে।
এখন সময় এসেছে—আমরা নিজের ডিজিটাল উপস্থিতি নিয়ে সচেতন হই, এবং ডিজিটাল শোককে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করি।
