Monday, June 30, 2025
27.7 C
Dhaka

বিএনপি কি নির্বাচনে চায়, নাকি শুধুই ক্ষমতা?

বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম বড় দল বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) আজ এক জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি—তারা কি সত্যিই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, অর্থাৎ নির্বাচনের মাধ্যমে, ক্ষমতায় যেতে চায়? নাকি তাদের মূল লক্ষ্য এখন শুধুই যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা দখল?

দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যায়, বিএনপির সাম্প্রতিক পদক্ষেপ, বক্তব্য এবং কৌশলগুলোর মধ্যে একটি গভীর দ্বন্দ্ব রয়েছে। যেখানে একদিকে দলটি নির্বাচনের গুরুত্বের কথা বলছে, অন্যদিকে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে। এই দ্বৈত আচরণ সাধারণ মানুষের মনেও প্রশ্ন তুলেছে—বিএনপি আসলে কী চায়?

নির্বাচনের প্রতি অনাস্থা

২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের পর থেকে বিএনপি মূলত “নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার” ছাড়া কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার নীতিতে অটল থেকেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তারা শেষ পর্যন্ত অংশ নিলেও নির্বাচন পরবর্তী সময় থেকে লাগাতার অভিযোগ করে আসছে যে এই নির্বাচন ‘প্রহসন’ ছিল।

২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা একেবারে ‘কঠোর’ আন্দোলনের দিকে গেল, যার পরিণতি হলো সহিংসতা, অচলাবস্থা এবং রাজপথের রাজনীতি। কিন্তু ফলাফল শূন্য—তারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এর ফলে প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপি আসলে জনগণের ম্যান্ডেট চায় নাকি বাইরের চাপ কিংবা সহিংস পন্থায় ক্ষমতা চায়?

আন্দোলন বনাম নির্বাচন

আন্দোলন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বীকৃত পদ্ধতি। কিন্তু আন্দোলনের লক্ষ্য যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণের বদলে সরাসরি সরকার পতন এবং ত্বরিত ক্ষমতা গ্রহণ হয়, তখন তা আর গণতান্ত্রিক থাকে না।

বিএনপির সাম্প্রতিক আন্দোলনে লক্ষ্য ছিল ‘আওয়ামী লীগ সরকার পতন’, কিন্তু সেই আন্দোলনে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। মূলত, কর্মীদের সংঘর্ষ, পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং অবরোধের মতো কার্যক্রমই বেশি দৃশ্যমান হয়েছে।

প্রশ্ন হলো—জনগণ যেখানে এখন উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা এবং শান্তি চায়, সেখানে সহিংস আন্দোলন কি আদৌ জনগণের সমর্থন আদায় করতে পারে? নাকি বিএনপির কৌশলই ছিল জনগণকে বাইরে রেখেই সরকার পতনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করা?

গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রুতি কতটুকু?

গণতন্ত্র মানে নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচন, পরাজয় মেনে নেওয়া, আবারও সংগঠিত হয়ে ফিরে আসা। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ আন্দোলন করে, বারবার পরাজিত হয়ে, অবশেষে ২০০৮ সালে বিজয়ী হয়। বিএনপির ইতিহাসেও আন্দোলন আছে, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মধ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি এক ধরনের অনাস্থা ফুটে উঠেছে।

একদিকে তারা “নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই” বলে দাবি করে, অন্যদিকে বর্তমান সংবিধানের আওতায় কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণই করে না। তাদের এই নীতি বাস্তবে “আমাদের ইচ্ছামতো সরকার না হলে নির্বাচন মেনে নেব না”—এই মনোভাবকে সামনে নিয়ে আসছে।

গণতন্ত্রে কেউ এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এটা বিশ্বাস করতে হয় যে জনগণই সর্বোচ্চ শক্তি। বিএনপি যদি এই নীতিতে আস্থা রাখত, তাহলে হয়তো আন্দোলনের চেয়ে সংগঠনের দিকে মনোযোগ দিত, নীতি নির্ধারণের মধ্যে জনগণের জন্য গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করত এবং নির্বাচনী মাঠে শক্তিশালী ভূমিকা রাখত।

আন্তর্জাতিক চাপের প্রত্যাশা

আরেকটি বিষয় স্পষ্ট—বিএনপি বড় অংশেই আন্তর্জাতিক চাপের ওপর নির্ভর করে। তারা বারবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিবৃতি, উদ্বেগ এবং পর্যবেক্ষণের দোহাই দিয়ে সরকার পরিবর্তনের আশা দেখিয়েছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ছাড়া আন্তর্জাতিক সমর্থন কখনো টেকসই পরিবর্তন আনতে পারে না—বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো শক্তিশালী রাজনৈতিক কাঠামোর দেশে।

ক্ষমতা না কি গণতন্ত্র?

সবশেষে বলা যায়, বিএনপির বর্তমান কৌশল ও পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে মেরামত করে জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরিকল্পনার চেয়ে, দ্রুত কোনোভাবে সরকার পতন ঘটিয়ে ক্ষমতায় ফেরার পথ খুঁজছে। এর ফলে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা কমছে এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠছে।

তাদের জন্য এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—বিএনপি কি আবার গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসবে? না কি অন্ধ শক্তির খেলায় নিজেদের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে ফেলবে?

উপসংহার

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল অপরিহার্য। বিএনপির উচিত হবে, নির্বাচন ব্যবস্থার দুর্বলতা চিহ্নিত করে গঠনমূলক উপায়ে তা সংস্কারের দাবি তোলা এবং জনগণের মাঝে সংগঠিত হওয়া।
কেবল নির্বাচন বর্জন বা সহিংস আন্দোলন নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই তাদের আসল শক্তি প্রকাশ পাবে। নইলে দিন শেষে প্রশ্নটা থেকেই যাবে—বিএনপি কি আসলে চায় জনগণের ম্যান্ডেট, নাকি শুধুই দ্রুত ক্ষমতা?

Hot this week

আয়াতুল্লাহ খামেনি ‘লাভিজান’ এর ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে কেন আশ্রয় নিয়েছেন?

১. পটভূমি ও বর্তমান পরিস্থিতিনৈঃশব্দ্য ভেঙে আক্রমণ: ২০২৫ সালের...

ইরানে হামলা কীভাবে ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেবে?

১. পটভূমি ও বর্তমান পরিস্থিতিজুন ২০২৫-এ ইজরায়েল "অপারেশন রাইজিং...

ডাইনোসর বিলুপ্তির ইতিহাস: যদি তারা এখনো বেঁচে থাকতো, আমাদের পৃথিবী কেমন হতো?

ডাইনোসর! নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল দেহ,...

সম্পর্ক শেষ, ইলন মাস্ককে কঠিন পরিণতির হুঁশিয়ারি ট্রাম্পের

এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প...

জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের গ্রেফতার বারহাট্টা আওয়ামী লীগ সভাপতি, এলাকায় উত্তেজনা

নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুল হালিমকে...

Topics

আয়াতুল্লাহ খামেনি ‘লাভিজান’ এর ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে কেন আশ্রয় নিয়েছেন?

১. পটভূমি ও বর্তমান পরিস্থিতিনৈঃশব্দ্য ভেঙে আক্রমণ: ২০২৫ সালের...

ইরানে হামলা কীভাবে ট্রাম্পের পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেবে?

১. পটভূমি ও বর্তমান পরিস্থিতিজুন ২০২৫-এ ইজরায়েল "অপারেশন রাইজিং...

সম্পর্ক শেষ, ইলন মাস্ককে কঠিন পরিণতির হুঁশিয়ারি ট্রাম্পের

এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র, যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প...

জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের গ্রেফতার বারহাট্টা আওয়ামী লীগ সভাপতি, এলাকায় উত্তেজনা

নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুল হালিমকে...

এমনভাবে আইন সংস্কার করতে চাই যাতে আর ফ্যাসিবাদ না গড়ে ওঠে

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার নানা প্রান্তে এক অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতা...

গাজা ও ইউক্রেন ইস্যুতে পশ্চিমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে অ্যামনেস্টির প্রধানের কড়া মন্তব্য

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সাম্প্রতিক এক মন্তব্য নিয়ে শুরু...

বাজেট ২০২৪–২৫: সাধারণ মানুষের জীবনে সম্ভাব্য অসুবিধা ও প্রভাব

বাংলাদেশ সরকারের নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা সাধারণ মানুষের জীবনে...
spot_img

Related Articles

Popular Categories

spot_imgspot_img