“বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক অসাধারণ বন্ধুত্বপূর্ণ” — এই লাইনটা আপনি বইপত্র, টকশো, আর রাজনীতিকদের মুখে প্রায়ই শুনে থাকবেন। কিন্তু একটু গভীরভাবে দেখলেই বোঝা যায়, এই সম্পর্কটা একতরফা। আর ভারতের দিক থেকে, এটা আসলে এক ধরণের আধিপত্য, এক ধরণের ‘স্ট্র্যাটেজিক শোষণ’। বন্ধুত্বের মুখোশের আড়ালে তারা যেভাবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে, সেটাকে আর নিছক কূটনৈতিক কৌশল বলা যায় না—এটা নিয়ন্ত্রিত উপনিবেশিকতা।
বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক – ‘স্ট্র্যাটেজিক শোষণ’
১. পানির রাজনীতি: তিস্তা একা নয়, গঙ্গাও ভাগ হয়নি
তিস্তা চুক্তির কথা আজ প্রায় দুই দশক ধরে শুনছি। কিন্তু ভারত শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে, কাজের কাজ কিছুই করছে না। তিস্তার পানি আটকে রেখে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ ঘটানো হচ্ছে। শুধু তিস্তা নয়—ভারতের ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে মাত্র একটি নদীতেই চুক্তি হয়েছে (গঙ্গা, ১৯৯৬), বাকিগুলো কেবল আলোচনা আর প্রতিশ্রুতির বৃত্তেই আটকে আছে।
এই পানির রাজনীতি ভারতের হাতে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, ও জীবিকাকে বিপন্ন করে তুলছে।
২. বাণিজ্যে ভারসাম্যহীনতা: রপ্তানিতে ঘাটতি, আমদানিতে ভরপুর
বাংলাদেশ ভারতের কাছে বছরে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে, অথচ রপ্তানি করে মাত্র ১-২ বিলিয়ন ডলার। ভারতের বাজারে আমাদের পণ্যের জন্য অশুভ শুল্কনীতি, নন-ট্যারিফ ব্যারিয়ার ইত্যাদি দিয়ে বাধা সৃষ্টি করে রাখা হয়। অথচ আমাদের বাজার ভারতীয় পণ্যে ভরা।
এটা কেবল অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়, এটি একটি বাণিজ্যিক শোষণ-নীতি, যেখানে বাংলাদেশ যেন একরকম কাঁচামাল বাজার ও ভোক্তা উপনিবেশ হয়ে গেছে।
৩. সীমান্ত হত্যা: প্রতিবেশী, না শত্রু?
বিএসএফ প্রতি বছর গড়ে ৫০-৬০ জন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে। কেউ গরু আনছিল, কেউ নাকি ভুলে সীমান্ত পার হয়েছিল—বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক অজুহাতে তারা গুলি চালায়। অথচ আন্তর্জাতিক আইন বলে, সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের আগে সতর্কতা বাধ্যতামূলক।
প্রতিটি গুলি, প্রতিটি লাশ ভারতের ‘বন্ধুত্বের’ মুখোশকে বিদীর্ণ করে দেয়।
৪. রাজনীতি ও প্রভাব বিস্তার: নেপথ্য নিয়ন্ত্রণ
বাংলাদেশে নির্বাচন এলেই ভারতের দিল্লি চুপ করে বসে না। তারা সব সময় চায় এমন সরকার, যাদের সঙ্গে তাদের ‘বিশ্বস্ত’ সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন সময় কূটনৈতিক চাপ, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, এমনকি ‘নির্বাচনপূর্ব সিগন্যাল’-এর মাধ্যমে তারা প্রভাব ফেলতে চায়—কে ক্ষমতায় আসবে, কে নয়।
ভারতীয় মিডিয়া পর্যন্ত অনেক সময় বাংলাদেশি রাজনীতিকে নিয়ে এমনভাবে কথা বলে—যেন তারা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ‘ওভারলর্ড’।
৫. ট্রানজিট ও করিডোর: রপ্তানি নয়, শুধু চলাচলের সুবিধা!
বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযোগ দিতে বহু ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তারা রেল, সড়ক, নৌপথে চলাচল করে কর ছাড়াই, অথচ বাংলাদেশ তার বিনিময়ে তেমন কিছু পায় না। গ্যাস-পানি-পথ—সবই যাচ্ছে, কিন্তু আসছে না কিছুই।
এটা কি বন্ধুত্ব? না কি এক ধরণের অসামান্য ধূর্ততা?
শেষ কথা: মুক্তিযুদ্ধে রক্ত দিয়েছিলাম, কিন্ত কতদিন মাথা নিচু করে থাকবো?
বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে ছোট হতে পারে আয়তনে, শক্তিতে—কিন্তু সম্মানে নয়। ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব হোক, তবে সেটা সম-মর্যাদার ভিত্তিতে। বারবার শোষিত হয়ে, নত হয়ে বন্ধুত্ব করা যায় না।
ভারত যদি সত্যিই বন্ধু হয়, তাহলে তাকে বন্ধু হওয়া শিখতে হবে। না হলে এই সম্পর্ক বন্ধুত্বের মুখোশ পরে শোষণের নাটক ছাড়া আর কিছু নয়।