লিখেছেন: [ প্রবন্ধ মিডিয়া ]
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স দীর্ঘদিন ধরেই একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। তবে সম্প্রতি এর প্রবাহে যে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে, তা শুধু পরিসংখ্যানগত নয়—বরং আর্থসামাজিক বাস্তবতায়ও এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
২০২৫ সালের মে মাসের প্রথম ২৪ দিনেই রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ২৭ হাজার ৪০১ কোটি টাকা—যা বাংলাদেশি টাকায় এক মাসের জন্য একটি ঐতিহাসিক রেকর্ডের ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে রেমিট্যান্স আসছে ১,১৪২ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রায় ৯.৩৫ কোটি ডলার। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে চলতি মে মাসে ৩ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করতে পারে প্রবাসী আয়।
রেমিট্যান্স কী এবং কেন তা গুরুত্বপূর্ণ?
রেমিট্যান্স হল বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের দেশে টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া। এটি সরাসরি পারিবারিক খরচ, সঞ্চয়, বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
▪️ মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে রেমিট্যান্সের অবদান:
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে রপ্তানি আয়ের চেয়েও বেশি অবদান রাখছে রেমিট্যান্স। এটি ডলারের সংকট মোকাবেলা, আমদানি ব্যয় সামলানো, এবং টাকার মান ধরে রাখা-তে সহায়ক।
রেমিট্যান্সের ধারা (২০২৪-২৫ অর্থবছর অনুযায়ী)
মাসরেমিট্যান্স (কোটি ডলার)জুলাই১৯১.৩৭আগস্ট২২২.১৩সেপ্টেম্বর২৪০.৪১অক্টোবর২৩৯.৫০নভেম্বর২২০.০০ডিসেম্বর২৬৪.০০জানুয়ারি২১৯.০০ফেব্রুয়ারি২৫৩.০০মার্চ৩২৯.০০ এপ্রিল২৭৫.০০মে (২৪ দিন)২২৫.০০+ ⏳
কোন ব্যাংক কতটা রেমিট্যান্স এনেছে?
রাষ্ট্রীয় ব্যাংক: ৬৬.৫৩ কোটি ডলার
বিশেষায়িত ব্যাংক: ২০.৫০+ কোটি ডলার
বেসরকারি ব্যাংক: ১৩৭.১৬ কোটি ডলার
বিদেশি ব্যাংক: ০.৪১৩ কোটি ডলার
অথচ, মে মাসের ২৪ দিনেও ৮টি ব্যাংক রেমিট্যান্স আনতে ব্যর্থ হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, কমিউনিটি ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক প্রমুখ।
কীভাবে বাড়ছে রেমিট্যান্স? কারণগুলো:
চ্যানেলিং ও হুন্ডির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা
নির্বাচনের পর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আস্থা বৃদ্ধি
ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রণোদনা (২.৫%) অব্যাহত রাখা
বিভিন্ন দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি (মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ)
শিক্ষণীয় দিক: কেন এটা শুধু রেকর্ড না, বরং একটা শিক্ষা
বাংলাদেশে এখনও বড় একটা অংশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল। তাই—
বিকল্প আয়ের খাত তৈরি না করলে, রেমিট্যান্সের ওপর অতিনির্ভরতা ভবিষ্যতে ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে।
প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের একটি বড় অংশ খরচ হয়, বিনিয়োগে নয়—যা টেকসই উন্নয়নে বাধা।
# এই অর্থকে স্মার্ট বিনিয়োগে রূপান্তর করতে পারলে তা হতে পারে শিল্পায়ন, উদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিপ্লবের হাতিয়ার।
আমাদের করণীয়:
রেমিট্যান্সভিত্তিক এসএমই বা ক্ষুদ্র শিল্পে প্রণোদনা বৃদ্ধি
‘রেমিট্যান্স ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান’ চালু করা
বৈধ চ্যানেলের গুরুত্ব বোঝাতে প্রবাসীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি
রেমিট্যান্স ব্যাংকিংয়ে প্রযুক্তি ও ডিজিটালাইজেশন
উপসংহার:
রেমিট্যান্স প্রবাহে বর্তমান উত্থান শুধু সংখ্যার গল্প নয়, বরং এটি জাতির অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। এই আয়ের যথাযথ ব্যবহার, সঠিক পরিকল্পনা ও টেকসই বিনিয়োগ ছাড়া শুধু রেকর্ড গড়েই আমরা তৃপ্ত থাকতে পারি না।
“অর্থ তখনই শক্তি, যখন তা ভবিষ্যতের ভিত্তি নির্মাণে কাজে লাগে।”