ভূমিকা
বর্তমান বিশ্বে একটি দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে তার জনসংখ্যার দক্ষতা ও কর্মসংস্থানের উপর। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষিত যুবকদের একটি বিশাল অংশ আজ বেকারত্বের কারণে সমাজে অবহেলিত ও হতাশায় নিমজ্জিত। একদিকে রয়েছে শিক্ষা অর্জনের প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে নেই উপযুক্ত চাকরির সুযোগ। এই অবস্থার পেছনে যেমন রয়েছে কাঠামোগত সমস্যা, তেমনি রয়েছে সরকারের দীর্ঘদিনের অবহেলাও।
বর্তমান পরিস্থিতি
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত বেকারদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। ২০১৭ সালে যেখানে স্নাতক পাস শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখ, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখে। শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১২% — যা জাতীয় বেকারত্বের হার অপেক্ষা বহুগুণ বেশি। উচ্চশিক্ষা নিয়েও তারা চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না, ফলে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ছে।
বেকারত্বের প্রধান কারণসমূহ
শিক্ষা ও শ্রমবাজারের অসামঞ্জস্যতা
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশি জোর দেওয়া হয় তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জনে, অথচ চাকরির বাজারে দরকার দক্ষতা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা।
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার অভাব
অধিকাংশ শিক্ষার্থী সাধারণ উচ্চশিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়ছে, কিন্তু কারিগরি বা পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণের দিকে আগ্রহ কম — যার ফলে তারা বাস্তব কর্মক্ষেত্রে উপযোগী হয়ে উঠতে পারছে না।
অভিজ্ঞতার ঘাটতি
চাকরির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়, কিন্তু সদ্য স্নাতকদের হাতে সেই অভিজ্ঞতা থাকে না। ফলে তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হতে পারে না।
সরকারি চাকরির সীমিততা ও বিলম্ব
সরকারি চাকরির পদ খালি থাকলেও দীর্ঘ নিয়োগ প্রক্রিয়া ও জটিলতা অনেককে নিরুৎসাহিত করে। অনেক সময় একটি নিয়োগ শেষ হতে দুই-তিন বছর লেগে যায়।
উচ্চ প্রত্যাশা ও পছন্দনির্ভরতা
উচ্চশিক্ষিত যুবকরা নির্দিষ্ট কিছু পেশা বা পদে আগ্রহী থাকেন, যার ফলে সহজলভ্য চাকরিও অনেক সময় গ্রহণ করেন না।
সরকারের অবহেলা
বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারত্ব বৃদ্ধির পেছনে সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যেমন:
নীতিনির্ধারণে ঘাটতি
শিক্ষানীতি ও শ্রমবাজারের মাঝে সমন্বয়ের অভাব বহু বছর ধরে বিদ্যমান। যুগোপযোগী ও চাকরিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা তৈরিতে ব্যর্থতা লক্ষ্য করা যায়।
কারিগরি শিক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না করা
সরকারের বাজেটে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব অনেকাংশেই কম। ফলে নতুন প্রজন্ম প্রয়োজনীয় দক্ষতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
উদ্যোক্তা বিকাশে সহযোগিতার ঘাটতি
তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ, ব্যবসা শুরুতে সরকারি সহায়তা যথেষ্ট নয়। অনেক প্রকল্প থাকলেও তা বাস্তবায়নে দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
চাকরিতে দুর্নীতি ও দলীয়করণ
সরকারি ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেতে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পরিচয়, ঘুষ বা তদবিরের প্রয়োজন হয় — যা মেধাবী অথচ প্রভাবশালী পরিবারে না থাকা তরুণদের জন্য বড় বাধা।
সমাধানের প্রস্তাবনা
শিক্ষার আধুনিকায়ন ও কর্মমুখীকরণ
শিক্ষাক্রমে প্রযুক্তি, উদ্যোক্তা শিক্ষা ও হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের সংযোজন করতে হবে। চাহিদাভিত্তিক কোর্স অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার
প্রত্যেক জেলায় আধুনিক কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে ছাত্ররা হ্যান্ডস-অন ট্রেনিং পাবে।
সরকারি চাকরির প্রক্রিয়ায় গতিশীলতা
নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, দ্রুত ও প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে। শূন্য পদ পূরণে নিয়মানুযায়ী সময়সীমা নির্ধারণ জরুরি।
উদ্যোক্তা তৈরি ও অর্থনৈতিক প্রণোদনা
তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণ, প্রশিক্ষণ ও ট্যাক্স ছাড় প্রদান করতে হবে। ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ’ ধরণের প্রকল্প বাড়াতে হবে।
বিদেশে চাকরির প্রস্তুতি ও পাঠানো
আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে কাজের সুযোগ তৈরির মাধ্যমে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি সম্ভব।
প্রাইভেট সেক্টর ও পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP)
প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সরকার অংশীদারিত্বে প্রকল্প হাতে নিলে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান দ্রুত তৈরি হবে।
উপসংহার
শিক্ষিত যুব সমাজ কোনো দেশের মেরুদণ্ড। কিন্তু তারা যদি বেকার থেকে যায়, তবে তা জাতির অগ্রগতির পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই সমস্যা সমাধানে সরকারের দৃঢ় সদিচ্ছা, নীতিনির্ধারকদের পরিকল্পিত পদক্ষেপ, এবং সামাজিক সচেতনতা একযোগে প্রয়োজন। আমাদের যুবকরা যদি যথাযথভাবে দক্ষ হয়ে উঠে এবং যথাসময়ে চাকরি বা ব্যবসার সুযোগ পায়, তবে তারা দেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল উন্নত রাষ্ট্রে রূপান্তর করতে সক্ষম হবে।