ভূমিকা:
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ৩০তম নিক্কেই ফোরামে অংশগ্রহণ করে এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি জানান, সরকার দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই ঘোষণা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ও সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
শান্তিপূর্ণ গণতন্ত্রের অঙ্গীকার:
ড. ইউনূস তার বক্তব্যে বলেন, “আমরা এমন একটি নির্বাচন আয়োজনের পথে রয়েছি, যা ন্যায়বিচার, সমতা, স্বাধীনতা ও মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করবে।” তিনি এটিকে গণতন্ত্রের শান্তিপূর্ণ ও কার্যকর রূপান্তরের পথ হিসেবে উল্লেখ করেন। বর্তমান বৈশ্বিক অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে এ বক্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
জনগণের ক্ষমতায়ন ও তৃণমূল নেতৃত্বের গুরুত্ব:
প্রধান উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেন, আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতায় জনগণের ক্ষমতায়ন ও তৃণমূল নেতৃত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র শীর্ষ নেতৃত্ব নয়, বরং তৃণমূল পর্যায়ের অংশগ্রহণেই টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এই বক্তব্য বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণভিত্তিক ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকট ও আন্তর্জাতিক ভূমিকা:
ড. ইউনূস তার বক্তব্যে বাংলাদেশের মানবিক ভূমিকা ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করেন। তিনি রোহিঙ্গা সংকটকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি যৌথ দায়িত্ব বলে মনে করেন এবং বাংলাদেশের অবস্থানকে ‘নৈতিক নেতৃত্বের প্রতীক’ হিসেবে তুলে ধরেন।
আঞ্চলিক সংহতি ও সহযোগিতার আহ্বান:
ড. ইউনূস বলেন, “এশিয়ার দেশগুলো অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও সমৃদ্ধির জন্য একসঙ্গে কাজ করতে পারে।” তিনি এশিয়ার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে শক্তি হিসেবে গণ্য করেন এবং বলেন, এই বৈচিত্র্য পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।
মানবিক বিপর্যয় ও যুদ্ধ-ব্যয়ের সমালোচনা:
বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ এবং সামরিক খাতে বিলিয়ন ডলারের ব্যয় প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, এই অর্থ দিয়ে যদি অনাহার, দারিদ্র্য ও মৌলিক চাহিদার সমস্যা সমাধানে ব্যয় করা হতো, তবে মানবতা অনেক বেশি উপকৃত হতো। তিনি মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও ভূমিকম্প-পরবর্তী সংকটকে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় বলে অভিহিত করেন।
সাত দফা পরামর্শ:
ড. ইউনূস তাঁর বক্তব্যে ভবিষ্যৎ শান্তিপূর্ণ, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির জন্য সাতটি দিকনির্দেশনা বা পরামর্শ দেন। যদিও সংবাদ প্রতিবেদনে সেগুলোর বিস্তারিত উল্লেখ নেই, অনুমান করা যায় যে সেগুলোর মধ্যে ছিল:
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি জোরদার করা
অংশগ্রহণমূলক নেতৃত্ব গড়ে তোলা
আঞ্চলিক সংহতি
মানবিক মূল্যবোধ
সামাজিক ন্যায়বিচার
অর্থনৈতিক ভারসাম্য
প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার
উপসংহার:
অধ্যাপক ইউনূসের এই বক্তব্য বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক ইতিবাচক বার্তা বহন করে। তার ঘোষণায় স্পষ্ট— সরকার নির্বাচনকে শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের টেকসই ভবিষ্যতের পথরেখা হিসেবে বিবেচনা করছে। এখন সময় এসেছে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা ও জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে এই অঙ্গীকার বাস্তবে রূপ দেওয়ার।
সুপারিশ:
১. নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করে গড়ে তোলা।
২. সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
৩. জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণ।
৪. আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের স্বাগত জানানো।
৫. সংবাদমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা।