জামায়াত বিএনপি জোট একসময় ছিল তারা অভিন্ন প্রাণ। একটি দল ছিল স্টিয়ারিংয়ে, আরেকটি ডান পাশে বসা বিশ্বস্ত নেভিগেটর। ২০০১ সালে এই জুটি যখন ক্ষমতায় এলো, তখন কেউ ভাবতেও পারেনি যে, একদিন সেই ‘বন্ধু’ হবে বোঝা। হ্যাঁ, বলছি বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের কথা।
একুশ শতকের রাজনৈতিক ইতিহাসে এদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট, অন্তত দেখাতে তাই মনে হতো। কিন্তু আজ? দৃশ্যপট পাল্টেছে। বিশেষ করে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান এর পর যেন বিএনপির ভেতর থেকেই একটা অদ্ভুত আওয়াজ উঠেছে—‘জামায়াত এখন আর আমাদের সঙ্গী নয়।’
কিন্তু প্রশ্ন হলো—এই অবস্থান হঠাৎ কেন?
আদর্শের কারণে? নাকি আন্তর্জাতিক মঞ্চে গ্রহণযোগ্যতার লোভে?
জামায়াত বিএনপি জোট – একটা অস্বস্তিকর ইতিহাস
বিএনপির রাজনৈতিক ইতিহাসের পেছনে তাকালে বোঝা যায়, জামায়াতের সঙ্গ ছাড়া তারা ২০০১ সালের সেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেত না। জামায়াত শুধু ভোট ব্যাংক ছিল না, ছিল মাঠের ‘কঠোর’ কর্মী বাহিনী। শহর থেকে গ্রাম—তাদের কাঠামো ও আদর্শ বিএনপিকে রাজনৈতিক শক্তি দিয়েছিল। কিন্তু সেই একই আদর্শ—আজ হয়ে উঠেছে ‘বোঝা’।
শাহবাগ আন্দোলনের পর যুদ্ধাপরাধের বিচার, আন্তর্জাতিক চাপ, তরুণ সমাজের প্রত্যাখ্যান—সব মিলিয়ে জামায়াত এখন অনেকের চোখে রাজনৈতিক বিষফোঁড়া। বিএনপি এখন বুঝেছে, জামায়াতকে পাশে রেখে নতুন প্রজন্মের হৃদয় জয় করা সম্ভব নয়। তাই শুরু হলো দূরত্ব তৈরির প্রক্রিয়া।
জুলাই: রাজনৈতিক নাটকের নতুন দৃশ্য
২০২৪ সালের জুলাই গণআন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতাদের মুখে এক নতুন সুর। কেউ কেউ সরাসরি জামায়াতকে ‘ঝুঁকি’ বলছেন, কেউ আবার বলছেন—তাদের রাজনীতি প্রাসঙ্গিক নয়। অথচ এই নেতারাই বছর পাঁচেক আগে একই টেবিলে বৈঠক করে আন্দোলনের রোডম্যাপ বানাতেন।
এখন দেখা যাচ্ছে, বিএনপির পদপ্রত্যাশী নেতারা নিজেরা জামায়াতকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখাতে মরিয়া। কারণ তারা জানে, আগামীতে যদি বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায়, তাহলে একক নেতৃত্বের বার্তা দিতে হবে। জোট নয়, দরকার একটা ‘নতুন বিএনপি’ ইমেজ।
জামায়াত বিএনপি জোট – তবে কী ক্ষমতার লোভেই ছেদ?
রাজনীতিতে আদর্শ শব্দটা যতই উচ্চারিত হোক না কেন, বাস্তবে দেখা যায়—ক্ষমতার কাছেই সবাই নতজানু। বিএনপির বর্তমান অবস্থানও অনেকটা সেরকম। তারা হয়তো চায় না জামায়াতকে দলে টেনে নিজেদের ঝুঁকিতে ফেলতে। আবার একেবারে সরিয়েও দিতে পারছে না—কারণ মাঠ পর্যায়ে এখনও কিছু জায়গায় জামায়াতের জনভিত্তি রয়েছে।
এটা একরকম ছদ্ম বিচ্ছেদ। মুখে ‘তোমার সঙ্গে আর নয়’, কিন্তু দরকার হলে আবার হাত ধরা যাবে—এই মানসিকতা নিয়েই চলছে বিএনপির রাজনৈতিক ‘ডামাডোল’।
শেষ কথায় প্রশ্ন
আদর্শের জায়গা থেকে যদি বিএনপি জামায়াতকে ছাড়ে, তাহলে সেটিকে সাধুবাদ জানানো যায়। কিন্তু যদি এটি কেবলই রাজনৈতিক ইমেজ বিল্ডিংয়ের অভিনয় হয়, তাহলে জনগণ সেটা ধরতেও দেরি করবে না। বাংলাদেশ এখন ‘পুরনো নাটক’-এর দর্শক নয়। মানুষ এখন দৃঢ় নেতৃত্ব চায়, নাট্যনির্ভর রাজনীতি নয়।
এখন দেখার বিষয়—বিএনপি সত্যিই নতুন কৌশলে এগোতে পারছে কিনা, নাকি আবার সেই পুরনো জোটেই ফিরে যাবে, যখন নির্বাচনী দরজা খুলবে। একটাই কথা—রাজনীতি ছদ্ম অভিনয়ের জায়গা হলে জনগণ একসময় হাততালি দেয়া বন্ধ করে দেয়।