প্রতিবেদক: [ প্রবন্ধ ]
ভূমিকা:
একসময় আলেকজান্ডার ফ্লেমিং যখন প্রথম পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি বলেছিলেন:
“এই ওষুধ কোটি কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচাবে, তবে একদিন মানুষ যদি নিয়ম না মেনে খায়, এটিই কাজ করবে না আর! তখন মানুষ তুচ্ছ রোগেও মরবে।”
আজ, সেই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। আমাদের অবহেলা, অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নামক ভয়াবহ সংকট আমাদের দ্বারপ্রান্তে।
এন্টিবায়োটিক কী?
এন্টিবায়োটিক হলো এমন ওষুধ যা ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে বা তাদের বৃদ্ধিকে থামিয়ে দেয়। এটি সাধারণত সংক্রমণ (ইনফেকশন) রোধে ব্যবহৃত হয়।
কিন্তু এই ওষুধ তখনই কাজ করে, যখন সঠিক মাত্রা (ডোজ), নির্দিষ্ট সময় (ডিউরেশন) এবং নির্ভুল রোগ নির্ণয়ের পর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খাওয়া হয়।
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কী?
এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স (Antibiotic Resistance) হচ্ছে এমন এক অবস্থা, যেখানে ব্যাকটেরিয়া নিজেদের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে নেয়, ফলে পূর্বে যে ওষুধে মারা যেতো, এখন আর তা কাজ করে না।
এর পেছনের মূল কারণ হলো:
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক খাওয়া
- নির্ধারিত কোর্স শেষ না করা
- ভাইরাল ইনফেকশনেও এন্টিবায়োটিক খাওয়া
- প্রাণী ও কৃষিক্ষেত্রে অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক ব্যবহার বাস্তব উদাহরণ:
ধরুন, আপনার শরীরে এক লাখ ব্যাকটেরিয়া আছে। চিকিৎসক বলেছেন ১০টি এম্পিসিলিন খেতে। আপনি খেলেন মাত্র ৭টি। তখন ব্যাকটেরিয়ার ৭০% মরলেও, বাকি ৩০% রয়ে যায়।
এই অবশিষ্ট ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজেদের মধ্যে “এন্টিবায়োটিক প্রুফ জ্যাকেট” বানিয়ে ফেলে।
এরা শুধু নিজেরাই নয়, তাদের বংশধরদেরও এই প্রতিরোধক্ষমতা দিয়ে জন্ম দেয়।
ফলে পরবর্তীবার সেই একই এন্টিবায়োটিক আর কাজ করে না। আপনি আরও বেশি অসুস্থ হন।
এবং ভয়াবহ দিক হলো, এই ব্যাকটেরিয়া হাঁচি, কাশি বা সংস্পর্শের মাধ্যমে অন্যদের শরীরেও ছড়িয়ে পড়ে।
ফলে পুরো একটি এলাকা বা জনপদেই সেই এন্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ে।
বৈশ্বিক প্রভাব:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ইতোমধ্যেই এটিকে একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট বলে ঘোষণা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি এখনই পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, ২০৫০ সালের মধ্যে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের কারণে বছরে ১ কোটির বেশি মানুষ মারা যাবে।
আমাদের অঞ্চলের ভয়াবহ অবস্থা:
“মেডিসিনের বাইবেল” নামে পরিচিত Davidson’s Principles and Practice of Medicine বইয়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে,
“This organism is resistant against this drug in the subcontinent.”
অর্থাৎ আমাদের উপমহাদেশে (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান) বহু ব্যাকটেরিয়া ইতিমধ্যেই বহু এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
এটা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য এক গভীর সতর্কবার্তা।
সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ:
হাসপাতাল থাকবে, চিকিৎসক থাকবে, কিন্তু কার্যকর এন্টিবায়োটিক থাকবে না।
সামান্য সংক্রমণও জটিল হয়ে রোগীকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাবে।
অস্ত্রোপচার বা ক্যানসারের চিকিৎসাও হবে বিপজ্জনক।
শিশুরা নিউমোনিয়ায়, বয়স্করা সর্দিজ্বরে প্রাণ হারাবে।
করণীয় ও প্রস্তাবনা:
করণীয়ব্যাখ্যা: এন্টিবায়োটিক শুধুমাত্র চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী গ্রহণনিজের ইচ্ছায় কখনোই এন্টিবায়োটিক শুরু নয়, কোর্স শেষ করামাঝপথে বন্ধ না করা, ভাইরাল ইনফেকশনে এন্টিবায়োটিক না খাওয়াসর্দি-জ্বর, করোনা, ডেঙ্গু ইত্যাদিতে এন্টিবায়োটিক কার্যকর নয় গবাদিপশু ও মুরগিতে অতিরিক্ত এন্টিবায়োটিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করাখাদ্যচক্রে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া
সচেতনতা বাড়ানোশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, গণমাধ্যমে প্রচারণা জরুরি
উপসংহার:
এন্টিবায়োটিকের অযথা ও ভুল ব্যবহার শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো সমাজ ও জাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এখনই যদি আমরা সচেতন না হই, তাহলে ভবিষ্যতের চিকিৎসা ব্যবস্থার হাতেই আর কোনো অস্ত্র থাকবে না।
আমরা চাই, আপনি বাঁচুন, সমাজ বাঁচুক, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিরাপদ থাকুক। আর সে জন্য একটাই অনুরোধ—
“এন্টিবায়োটিক খেলেই হবে না, নিয়ম করে খেতে হবে। না হলে ব্যাকটেরিয়াই জিতে যাবে, মানুষ হেরে যাবে!”